চৈত্র সংক্রান্তি

পয়লা বৈশাখটা আমাদের কাছে
এমন একটা আবেগ…
যা আমাদের পিছনের বছরের কথা
এক নিমেষে ভুলিয়ে দিতে পারে।
হয়তো বা, জীবনের কিছু স্মৃতি, কিছু মুহূর্ত
পয়লা বৈশাখের থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী;
যা আস্তে আস্তে বিস্তার করে
নিজের একরোখা প্রভাব।।

এমনই এক শেষ চৈত্রের
পড়ন্ত আলগা রোদ্দুরের আলোয়,
স্নিগ্ধ ছায়াটুকু দেখেছিলাম তোমার।
বৈশাখ না আসতেই দুরন্ত কালবৈশাখীর মতো
ধেয়ে এসেছিলে আমার জীবনে।
আস্তে আস্তে প্রখর হলো রাজা।
ব’ইতে লাগলো মিঠে দখিণা বাতাস।
‘মহাভারত’- এর মতো, না চাইতেও শুদ্ধ হলাম আমি।
সেই শুদ্ধতার ভার আজও বয়ে চলেছি আমরা।
জানো, মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে খুব বেশি।
ভরসা’র দরকার হয় দুর্গা’র ও।।

বৈশাখের শেষ ভাগে জন্ম হল আমার কবির;
কবির কবিত্বের বিস্তার এখনো বাকি।
…আর আমাদের!!…সে কথা আজ থাক।।

তারপর, এক শ্রাবণ-সন্ধ্যায় আবার এলে তুমি;
বিদ্যুতের ঝলকানির সাথে,
ভেজা শালুকের গন্ধ মেখে।
এক নজর দেখেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিলাম।
সহজ ছিল না…
তবুও দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায় সফল হলাম।
‘গীতবিতান’ হাতে নিয়ে
অপলকে তাকিয়েছিলে আমার দিকে।
জিজ্ঞাসা করলাম,”কী দেখছো অমন করে?”
বলেছিলে,”সূর্য রেখে জ্বালবো তোর চোখে।”
বলেছিলাম,”ধুর! তাই আবার হয় নাকি!!”
বললে,”কেন হবে না?
…তুই চাইলেই সব হয়।”
কেমন যেন একটা অদ্ভুত বিশ্বাস ছিল
তোমার কথার মধ্যে।
সেদিন বুঝিনি…আজ বুঝি।
আমি চেয়েছিলাম বলেই হয়তো….

তারপর, আরো অনেকটা সময় কাটলো–
বৃষ্টির গুঞ্জন আর বাতির আবছায়া আলোয়।
সময় ফুরিয়ে এসেছিল প্রায় বাতিটার সাথে সাথে।
অনেক কথা না বলা রেখেই উঠতে যাব…
তুমি হাতটা ধরে বললে,
—“একটা গান গাইবি, আমার জন্য?”
কোনো উত্তর না দিয়েই,
শ্রাবণের আবহে আমি গাইলাম,
“…আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস।
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী,
দীর্ঘ বরষ-মাস।।”

সেই বছর শরতের শেষে দুর্গাপূজা হয়েছিল,
মনে আছে?
অষ্টমীর অঞ্জলির শেষে
তোমাকে দেখেছিলাম, নতুন রূপে।
মানিয়েছিল কিন্তু বেশ…
পুরুষচিহ্নস্বরূপ পরিণত গোঁফ,
চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা,
পরিধানে হলুদ পাঞ্জাবী- লাল ধুতি।
ইচ্ছে হলো, আবার নতুন করে আলাপ করি শুরু…
সমাজ-বিধির নিয়ম লঙ্ঘন না করেই
আলাপ সারলাম চোখের ইশারায়,
অনেকের অলক্ষ্যে।
সেদিন বুঝেছিলাম,
সংসারের সন্ন‍্যাস শরতের যৌবনেই এনেছে
হেমন্তের পরিপূর্ণ ছাপ।
সেদিন দিনের আলোর মতো,
প্রকাশ‍্যে ছিল সবকিছু;
কিন্তু সূর্যোদয় হয়নি।
তোমায় চিনিনি, চোখে কুয়াশা ছিল বলে।
কুয়াশা.. আজ আমি তোমার কাছে ঋণী।।
বিশ্বাস করো, আমি আজও চিরবসন্তের রূপ,
আর তুমি কুঁকড়ে থাকো, শীত আসবে বলে।
কুয়াশায় ডুব দেওয়াটা তোমার কাছে বিলাসিতা।
আমার বিলাসিতা….
আমি আজও তোমাকে বোঝাতে পারিনি–
কুয়াশা সরে গেলেই রঙের আগুন নিয়ে বেরিয়ে আসে
কৃষ্ণচূড়া-পলাশরা।।

…একটা কথা কি জানো?
মুহূর্তরাই বেঁচে থাকে, ওরা অমর।
নতুন আসবে, পুরনো যাবে;
শেষ থেকে শুরু…
…বা শুরু থেকে শেষ
যাই হোক না কেন—
প্রতিটা চৈত্রসংক্রান্তিতে এসে উপলব্ধি করি;—
তুমি আছো…রুদ্রবেশে।।

—————————–

রচনায়: সোমা কুণ্ডু, ভারত।

লেখক পরিচিতি

blank
eiapotrika